বাংলার ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য কালিজিরা ও কাটারিভোগ চাল
কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্যে ঈর্ষণীয়। আর বাংলার কৃষির অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে ধান। যেহেতু ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য, দেশের শতকরা ৮০ ভাগ জমিতে ধানের চাষ হয়। আমাদের খাবারের প্লেটের বেশির ভাগ জুড়ে থাকে ভাত। তাই খাদ্য নিরাপত্তা বলতে আমরা ধান বা চালের নিরাপত্তাকে বুঝি। সোনালি ধান, সোনালি স্বপ্ন, এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলার মাঠঘাট বছরের অধিকাংশ সময়ই সবুজ ধানে আবৃত থাকে। মাঠেঘাটের বিবর্ণ প্রকৃতিকে ঘিরে ফেলে সোনালি আভরণে। দেখে মনে হয় এ যেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরই স্বপ্নের সেই ‘সোনার বাংলা’।
সাম্প্রতিক সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি জমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে এখন রোল মডেল। দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনীতে শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। স্বাধীনতার পর ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। পাল্টে গেছে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার চিত্র। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও চাল রপ্তানি করছে। দ্রুত নগরায়ন, মানুষের মাথাপছিু আয় বৃদ্ধি এবং রুচি ও অভ্যাস পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে বাড়ছে সরু ও সুগন্ধি চালের ব্যবহার।
সরু ও সুগন্ধি চালের তৈরি নানান মুখরোচক খাবার আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশে কৃষক তাঁর জমির কোণে বা কোনো একটি অংশে চাষ করে আসছে সুগন্ধি সরু বা চিকন ধান। উদ্দেশ্য ঈদ-পূজা-পার্বণসহ নানা উৎসব ও আয়োজনে অতিথি আপ্যায়নে সুগন্ধি চালের তৈরি পোলাও, বিরিয়ানি, কাচ্চি, ফিন্নি, পিঠাপুলিসহ নানান মুখরোচক খাবার পরিবেশন। কালের বিবর্তনে প্রচলিত দেশি জাতের স্থলে এসেছে উচ্চফলনশীল সুগন্ধি ধানের জাত। এখন শুধু পারিবারিক প্রয়োজনে নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সরু ও সুগন্ধি ধান চাষ হচ্ছে। কারণ এই ধান চাষে সমান শ্রমে লাভ বেশি। কেননা সরু ও সুগন্ধি চালের দাম অন্য যে কোনো চালের তুলনায় অনেক বেশি। এক কেজি সাধারণ চালের দাম যেখানে ৪৫-৫০ টাকা সেখানে এক কেজি সরু ও সুগন্ধি চালের দাম ৮০-১২০ টাকা পর্যন্ত হয়। এই চালের রয়েছে দেশ বিদেশে ব্যাপক চাহিদা। গর্বের বিষয় হলো সম্প্রতি আমাদের দেশীয় দুটি সরু ও সুগন্ধি ধানের জাত ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
কোন দেশের পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। এই পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়। কোনো একটি দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) এই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে। যে ব্যক্তি/ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা জিআই এর জন্য আবেদন করেন সেটার মেধাস্বত্ব তাদের দেয়া হয়। দেশে ২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন প্রথম বারের মতো পাশ হয়। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় ডিপিডিটি।
সেই মোতাবেক প্রথম বারের মতো জিআই পণ্য হিসেবে ২০১৬ সালে স্বীকৃতি পেয়েছিল জামদানি। এরপর ২০১৭ সালে ইলিশ, ২০১৯ সালে খিরসাপাতি আম, ২০২০ সালে ঢাকাই মসলিন এবং চলতি বছর নিম্নোক্ত ৫টি পণ্যকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এখন থেকে এই পণ্যগুলো বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাবে। নতুন নিবন্ধিত জিআই পণ্যগুলো হলো- রাজশাহী সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, কালিজিরা চাল, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল এবং নেত্রকোনার সাদামাটি। আজকে নতুনভাবে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া কালিজিরা ও কাটারিভোগ চাল নিয়ে আলোচনা করব।
কালিজিরা ধানটি দেখতে কালো বর্ণের এবং দানার আকৃতি ছোট হওয়ায় একে দেখতে অনেকটা কালিজিরা নামক মসলার মতো দেখায় এবং এই কালিজিরা মসলার সাথে এই ধানের বাহ্যিক সাদৃশ্য থাকার কারণেই এই ধানের নাম কালিজিরা। তবে ধানের খোসা ছাড়ালে তখন চাউলের রঙ কালো থাকে না, চালের রঙ সাদা হয়ে থাকে। কালিজিরা ধানের আদি উৎপত্তিস্থল ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে অবস্থিত ময়মনসিংহ অঞ্চল। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম উইলসন হান্টার সম্পাদিত ‘অ ঝঃধঃরংঃরপধষ অপপড়ঁহঃ ড়ভ ইবহমধষ’ নামক গেজেটে ময়মনসিংহ অঞ্চলে কালিজিরা ধানের চাষাবাদ সম্পর্কে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও বিশিষ্ট ধান বিজ্ঞানী ড. তুলসি দাসের ‘অৎড়সধঃরপ জরপবং’ বইটিতেও ময়মনসিংহ অঞ্চলে কালিজিরা ধানের চাষাবাদের উৎস সম্পর্কে প্রমাণ পাওয়া যায়।
কালিজিরা ধানটি রোপা আমন মৌসুমে চাষাবাদ করা হয় এবং উৎপাদনের উপযোগী আবহাওয়া হলো সর্বোচ্চ ৩০০ সেন্টিমিটার এবং সর্বনিম্ন ১৭০ সেন্টিমিটার তাপমাত্রা এবং বার্ষিক ২০০০-২২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। ময়মনসিংহ অঞ্চলের আবহাওয়া এবং কৃষি পরিবেশগত অবস্থা সুগন্ধি জাতের ধান চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী, বিধায় যুগ যুগ থেকে ওই অঞ্চলের কৃষকের জমিতে কালিজিরা জাতের ধান চাষ হয়ে আসছে।
এই চালের মোহনীয় সুগন্ধী এবং অপূর্ব স্বাদের জন্য ইহা বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে পোলাউ, মিষ্টান্ন (যেমন : পায়েস কিংবা ফিরনি) ইত্যাদি ভোজনাদি তৈরিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। কালিজিরা ধানের উৎপত্তিস্থল ময়মনসিংহ অঞ্চল হলেও কালের বিবর্তনে এই ধানের অতুলনীয় স্বাদ, গন্ধ এবং গুণাগুণের জন্য পরবর্তিতে এই ধান সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পরে।
সুগন্ধি ধানের মধ্যে কাটারিভোগ একটি অন্যতম জনপ্রয়ি জাত। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইজজও) জিনব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসে দিনাজপুর থেকে কাটারিভোগ ধান ইজজও জিনব্যাংকে সংগ্রহ করা হয়। তবে বিভিন্ন সময়ে ময়মনসিংহ, মাগুরা, টাঙ্গাইল, সিলেট হতেও কাটারিভোগ ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে কাটারিভোগের মূল উৎপত্তিস্থল দিনাজপুর। দিনাজপুর জেলা গেজেট অনুসারে, কাটারিভোগ দীর্ঘ অনেক বছর ধরে চাষ করা হয়। কাটারিভোগ জাতটির চাল সরু ও সুগন্ধি। পূর্ববাংলা জেলা গেজেটিয়ার, ১৯১২ মোতাবেক কাটারিভোগ জাতটি দিনাজপুর জেলায় চাষাবাদ করা হয়। এ ছাড়াও, স্বাধীনতার পরে দিনাজপুর জেলা গেজেটিয়ার, ১৯৭২ মোতাবেক কাটারিভোগ জাতটি দিনাজপুর জেলায় চাষাবাদের প্রমাণ পাওয়া যায়।
নদীর অববাহিকায় অবস্থিত দিনাজপুরের মোট জমির শতকরা ৮২ ভাগ জমিতে ধান চাষ করা হয়। অধিকাংশ কৃষকই আমন ধানের চাষ করে থাকেন। দিনাজপুরে উৎপাদিত আমন ধানের মধ্যে কাটারিভোগ অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা দিনাজপুর পরিবেশগত কারণে এই জাত চাষাবাদের জন্য উপযোগী। দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর এলাকায় কৃষক জনাব মোঃ মোকলেছুর রহমান বলেন, প্রাচীনকাল হতেই এই কাটারিভোগ ধানের জাতটি দিনাজপুরে চাষ হয়ে আসছে। কৃষক তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন- এই কাটারিভোগ ধানের জাতটি দিনাজপুর ব্যতীত অন্য এলাকায় চাষ করলে সুগন্ধি কমে যায়।
নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করলে কাটারিভোগ ধানের ঘ্রাণ কিছুটা কমে যায়। শুধু গোবর সার দিয়ে এ ধান চাষ করলে তা গুণেমানে উৎকৃষ্ট হয়ে থাকে। আমাদের গবেষণায় দেখা যায় যে, বিশেষ সরু ও সুগন্ধিযুক্ত কাটারিভোগ ধান বেশি পরিমাণে ও বাণিজ্যিকভাবে দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলায়ই চাষাবাদ করা হয়ে থাকে।
কাটারিভোগ ধানের গড় জীবন কাল ১৩২ দিন। গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৩.২ টন অথবা একর প্রতি ৩২ মণ। এ কাটারিভোগ ধানের জাতটির মরফোলজিক্যাল ও মলিকুলার বৈশিষ্ট্যায়ন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে সম্পন্ন হয়েছে।
একশত কেজি কাটারিভোগ ধান মেশিনে ভাঙিয়ে ৭০.৫ কেজি চাল পাওয়া যায়। মেশিনে আস্ত চালের প্রাপ্তি ৬৫.৫০%। চালের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ২.৮৯ অংশ। চালে এমাইলোজ, প্রোটিন, দস্তা এবং আয়রনের পরিমাণ যথাক্রমে ২৩%, ৭.৩%, ১৯.৫ মি.গ্রাম/কেজি, ১০.০ মি.গ্রাম/কেজি। কাটারিভোগ চালের চাহিদা সারা দেশব্যাপী তৈরি হয়েছে। বিধায় দিনাজপুরের চাল ব্যবসায়ীগণ কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এ চাল গ্রাহকের নিকট পৌঁছে দিয়ে থাকেন।
বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় কালিজিরা ও কাটারিভোগসহ আধুনিক উচ্চফলনশীল সরু ও সুগন্ধি ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিদিষ্ট জেলাভিক্তিক চাষ হওয়া সুগন্ধি সরু বা চিকন ধানের আবাদ সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। সুগন্ধি ধানের ন্যায্যমূল্যে নিশ্চিত করতে সঠিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে এবং ব্যাপক প্রচার ও প্রচারণার মাধ্যমে বাংলার সুগন্ধি ধানের মান, পুষ্টিগুণের কথা দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। সকলের মাঝে বিদেশি সুগন্ধি জাতের চালের উপর নির্ভরতা কমিয়ে বাংলামতিসহ দেশীয় সুগন্ধি চালের তৈরি নতুন নতুন আকর্ষণীয় খাবারের প্রতি উৎসাহিত করতে পারলেই সুগন্ধি ধানের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসবে। এতে কৃষকরা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হবে তেমনি দেশের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক : ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল- ০১৮২৮-৩০৮৫৩০, ই-মেইল :smmomin80@gmail.com